শ্রীলঙ্কায় পতন ঘটল তামিল ইলমের

তামিল ইলমের জন্ম : ১৯৪৮ সালে শ্রীলঙ্কায় ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতীয়তাবাদের নগ্নরূপ দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর সিংহলি ভাষা কে দ্বীপরাষ্ট্রের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয় এবং তার সাথে সে দেশে বহু বছর ধরে বসবাসকারী তামিলদের জীবনের সমস্ত প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে থেকে সরিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা শুরু হয় সরকারি মদতে।

সরকার প্রণীত নানারকম বৈষম্যমূলক আইন সেদেশের তামিল ভাষাভাষী মানুষকে কোণঠাসা করে ফেলে এবং এরকম অবহেলার ফল ১৯৬৩  সালে তামিল জনগোষ্ঠীর মনে তামিল ইলমের ধারণার জন্ম হয়। ধীরে ধীরে দেশের নানা অঞ্চলে উগ্রপন্থী সংগঠনের জন্ম হয় এবং সেই সব গোষ্ঠীদের মধ্যে অগ্রগণ্য তামিল নিউ টাইগার থেকে ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ এর নেতৃত্বে জন্ম নেয় লিবারেশন অফ তামিল ইলম বা LTTE নামক উগ্রপন্থী তামিল সংঘঠনের, ১৯৭৬ সালে। 


এলটিটিই-এর আন্দোলনে ভারতের ভূমিকা:


১৯৮০ সালে থেকে তামিল আন্দোলনকে ভারত সমর্থন করে আসছে। তামিল সন্ত্রাসবাদীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া ও আর্থিক সাহায্যর ক্ষেত্রে ভারত যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। ১৯৮৭ সালে ভারতীয় বায়ুসেনা শ্রীলংকা সরকারের আপত্তি সত্বেও জাফনাতে খাদ্য ও ওষুধ ফেলেছে। এরপর ১৯৮৭ সালে ২৯ জুলাই ভারত-শ্রীলংকা শান্তি রক্ষার জন্য Indian Peace Keeping Force পাঠায় যারা প্রত্যক্ষভাবে শ্রীলংকা সরকারকে সাহায্য করে। 

এরপর থেকেই ভারত সরকার LTTE এর শত্রুতে পরিণত হয়। সিংহলি রাও তাদের দেশে ভারতীয় ফৌজ এর উপস্থিতিতে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে। ৩২  শ্রীলংকা অভিযানে ১১০০  ভারতীয় সেনা মারা যায় এবং ভারত সরকারের ব্যয় হয় ২০  বিলিয়ন ডলার।  অবশেষে ১৯৯০  সালের 24 মার্চ  শ্রীলংকা থেকে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।  এই ঘটনার প্রত্যক্ষ প্রভাবেই ১৯৯১  সালের  এলটিটিই  তরফ থেকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়।

১৯৯৮  সালে ভারতীয় বিশেষ বিচারক  ডি.ডনিদম এলটিটিই ও তার সংগঠনের  প্রধান প্রভাকরণ কে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেন।


এলটিটিই এর দ্বিতীয় লড়াই


  এই সন্ত্রাসবাদি সংগঠনটি রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ প্রথম শুরু করে ১৯৮৩  সালের জুলাই মাসে।  তখন তাদের ক্যাডারদের আক্রমণে শ্রীলংকার ১৩  জন সেনা মারা যায়। এর প্রতিক্রিয়ায় সরকারের মদতে ৩০০০  তামিল হত্যা করা হয়।  এরপর তামিল ইন সাফল্য লাভ করে বেস্ট ও ডলার ফার্মের হত্যার মাধ্যমে। 

তারপর ১৯৮৫  অনুরাধাপুর এর গণহত্যা ইত্যাদি ঘটনা ঘটে। ১৯৯০  সালের অক্টোবর মাসে এলটিটিই বসবাসকারী সমস্ত মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বহিষ্কার করে। ১৯৯৩  সালের মে মাসে শ্রীলংকা রাষ্ট্রপতি প্রেমদাসা এক আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণে মারা যায়।  এরপর রাষ্ট্রপতি হন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা।  কিন্তু তিনিও ১৯৯৯  সালে এক ভয়াবহ আক্রমণে মারাত্মক আহত হন তাতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।

 সম্ভাব্য শান্তি প্রক্রিয়া:  এলটিটি শ্রীলঙ্কা সরকারের মধ্যে প্রথম শান্তি আলোচনা শুরু ১৯৮৫  ভূটানের থিম্পু।  তবে সে আলোচনা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যায় এবং সংঘর্ষ আবার বাড়তে থাকে।  এরপর ১৯৮৭  এলটিটি প্রথম আত্মঘাতী হামলা চালায়।  এরপর দ্বিতীয় শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০১  সালের ১৯  ডিসেম্বর  নরওয়েতে। 

সেই সময় এই ৩০ দিনের যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে এবং সরকারি সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে হামলা থামানোর প্রতিশ্রুতি হয়। ২০০২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি একটি মেমোরেন্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং স্বাক্ষর করে। একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।  শান্তি প্রক্রিয়ার অগ্রগতি দেখার জন্য শ্রীলংকা মনিটরিং মিসন গঠন করা হয়।  প্রস্তাবিত শান্তি বৈঠক শুরু হয় ১৬ ডিসেম্বর থাইল্যান্ডের।  তারপরও জার্মানিকে অশান্তি বৈঠক হয়। 

এলটিটিই এর পতন: ২০০৬ সালে সুইজারল্যান্ডে আয়োজিত শান্তিপ্রক্রিয়া ব্যর্থ হবার পর এলটিটিই পুনরায় শ্রীলঙ্কা সরকারের সাথে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়।  এরপর ওই বছর ৮ ডিসেম্বর শ্রীলঙ্কা শ্রীলঙ্কা এলটিটিই এর ওপর আক্রমণ চালায়। ২০০৭ এর ১৯ জানুয়ারি সেনাবাহিনী ভাড়ায় দখল করলে টাইগারদের বাহিনী পূর্বপুরুষের উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। ২০০৭ এর ২৬ নভেম্বর সেনা বাহিনীর বিমান হামলায় প্রভাকরণ আহত হয়েছেন বলে সরকার দাবি করে। 

তারপর ২০০৮ সালে ২৩ নভেম্বর শ্রীলংকার সেনাবাহিনী এলটিটিই’র আসল ঘাঁটি আক্রমণ করে এবং ২০০৯ এর ২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী সেনাদের কথা ঘোষণা করেন।  তারপর বহু যুদ্ধের পর 16 মে প্রধানমন্ত্রী শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর জয়ের ঘোষণা করেন।  তবে তখনো প্রভাকরণের কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। 

তখন এলটিটিই মুখপাত্র ও পরাজয় স্বীকার করে প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।  এই সময় শ্রীলংকার সেনাবাহিনী জানায় যে এক রকেট হামলায় এলটিটিই সুপ্রিমো প্রভাকরণ মারা গেছেন।  এইভাবে ৩৩ বছর ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটে গত ১৭ ই মে।

 উপসংহার:  তবে প্রভাকরণের মৃত্যুর সাথে সাথেই শ্রীলংকার তামিলরা অবসান ঘটবে স্থায়ীভাবে কথা এখনই জোর দিয়ে বলা যাবে না।  যদিও সরকার ভবিষ্যতে তাদের সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষিত হবে তা নিয়ে বিতর্ক থেকেই গেছে।  তবে সরকার যদি আবার কোন দমনমূলক নীতি গ্রহণ করেন সেখানকার তাদের বিরুদ্ধে তাহলে আবার কিন্তু কোন প্রভাকর জন্ম নেবে।

হেলিকপ্টার বিপর্যয় অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ইয়েদুরি সন্দিতি রাজশেখর রেড্ডি

Leave a Comment