ভূমিকা :- ইতিহাস থেকে এটা সুস্পষ্ট হয় যে কোনো শাসনই চিরস্থায়ী নয়। পশ্চিমবঙ্গের বাম শাসন ও তার ব্যতিক্রম নয়। আসলে জনগণের স্থির করেন যে কে শাসন করবে আর কার শাসন করবার প্রয়োজন নেই। কংগ্রেসের শাসন থেকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭৭ সালে জনগণ বামফ্রন্ট সরকারকে ক্ষমতায় এনেছিল। আবার ৩৪ বছর পর তাদের সরিয়ে জনগণই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে ক্ষমতায় নিয়ে এসেছেন। আবার সঠিক কাজ পেলে তার সরকারকে জনগণ রাখবেন না হয় সরাবেন। জনগণই শেষ কথা বলবেন।
মমতার জয় আর বামফ্রন্টের পরাজয়ের কারণ:- বিশ্বের ইতিহাসে কোন শাসন চিরস্থায়ী হয়নি । পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্ট সরকারকে ৩৪ বছর পর বিদায় নিতে হলো। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বে কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেসের জোটের সরকার হল। এর বেশ কিছু কারণ আছে।
প্রথমত, ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর কর্মীদের মধ্যে যে উৎসাহ ছিল এখন আর তা নেই। তারা মানুষের দুঃখে এগিয়ে আসে না। নেতারা নিজেদের সুখ-সুবিধা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তারা মানুষকে হয়রান করে। সেজন্য বেশ কিছু সমর্থকের বামফ্রন্ট সম্বন্ধে মোহ থাকে না।
দ্বিতীয়তঃ শহরে সরকারি অফিসগুলোতে মিডিয়ায় ভয়ে কিছু কাজ হলেও গ্রামের অফিস গুলিতে কোন কাজ হয়না। থানা থেকে বি.এল.আর.ও অফিস পর্যন্ত মানুষ অর্থ দিয়েও পরিষেবা পায়নি। যে সমস্ত মানুষের দুঃখ যন্ত্রণা একত্রিত হয়েছে। এতদিন শক্ত বা জোরালো কোনো বিরোধী দল ছিল না যে বামফ্রন্টকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে এবার কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেসের শক্তিশালী জোট থাকায় মানুষ তাদের দুঃখ ভোটের বাক্সে স্পষ্ট করেছে।
তৃতীয়তঃ বিভিন্ন পাড়ায় কিছু মস্তান তৈরি হয় যাদের শিক্ষা সংস্কৃতি আর রুচি থাকে না। তাদের অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দল এদের পোষণ করেছে, তাদের ছত্রছায়ায় রেখেছে অথচ নিয়ন্ত্রণ করেনি। সে জন্য মানুষকে বাধ্য হয়ে এদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে কিন্তু তারা ভোটের বাক্সে তাদের দুঃখকে স্পষ্ট করেছে। সেজন্য মমতার জয় হয়েছে।
চতুর্থত: স্বজনপোষণ যেকোনো রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য। বামফ্রন্ট তার বাইরে নয়। চাকরির বিষয়ে নেতাদের আত্মীয়-স্বজন আর পার্টির লোকজন যেভাবে সুযোগ পেয়েছে সাধারণ মানুষ তা পাইনি। আবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সেজন্য তাদের মনে বিরূপ মনোভাব থাকবে তাদের ভোট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেয়েছেন।
পঞ্চমত শহরে প্রোমোটার রাজ শুরু হওয়ার পর অনেকে জমি হারিয়েছেন। প্রার্থীর সমর্থনে অনেক প্রোমোটার অনেকের ভিটে কেড়ে নিয়েছে। কেউ নতুন বাড়ি করতে চাইলে বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহের কাজ থেকে অধিক মূল্য নিকৃষ্ট উপকরণ কিনতে হয়েছে। তারপর পাড়ার ক্লাব কে আর দাদাকে চাঁদা না দিলে চলবে না ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তোলা নেওয়া হয়েছে সেজন্য তাদের রাগ হয়েছে।
একদিন সংখ্যালঘু ভোটের একটা অংশকে পেত কংগ্রেস। একটা অংশকে তৃণমূল কংগ্রেস। আর অধিকাংশ ভোটই পেত বামফ্রন্ট। সেই ভোট তৃণমূল কংগ্রেসের দিকে ঝোকে। এজন্য বামফ্রন্টের মুসলিমদের তেমন উন্নতি হয়নি। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরূপ হয়। মমতা তাদের সমস্যার সমস্যা সমাধান করতে চান। এজন্য তারা তাকে ভোট দেন।
বামফ্রন্টের ভূমি সংস্কার সারা ভারতে প্রশংসা পেয়েছে। কিন্তু ভূমি সংস্কারের সঙ্গে শিল্পায়ন করতে গিয়েই ভরাডুবি হলো। ফসল উঠলে ঋণের দায়ে ফসল কম দামে বিক্রি করে দিতে হয়। বছরের অধিকাংশ সময় তাদের অভাব থাকে। খরা, বন্যা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো আছেই। কিন্তু তবু তারা শিল্পের কথা ভাবতে পারে না। সরকার সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের শিল্পায়ন করতে গেলে বাধা আসে। বিরোধীরা তার সুযোগ নেয় কৃষকরা সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায় । শিল্প না হওয়ায় শিল্পপতি ব্যবসা বন্ধ করে অন্য রাজ্যে চলে যান। শিল্প ছাড়া উন্নয়ণ সম্ভব নয় এটা অনেকেই বোঝেন না।
এছাড়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের সরকারের প্রশাসনিক দুর্বলতা সরকারের ব্যর্থতাকে সুস্পষ্ট করে। শিল্পায়ন করতেই একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ভূমিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে।
যেকোনো দেশে রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিশ্চিত করতে সংবাদমাধ্যমের এক বিশিষ্ট ভূমিকা আছে। সাধারণ মানুষের কাছে সংবাদমাধ্যমের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। তাদের ধারণা আছে যে ছাপার অক্ষরে লেখা ভুল হতে পারে না। বামফ্রন্ট যখন ইউপিএ সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেয় তখন থেকেই সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়। আর বেশিরভাগ সংবাদপত্র এবং চ্যানেল বিধানসভা নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের বিরোধিতা করে আর বিরোধী নেত্রীকে সমর্থন করা সাধারণ মানুষের মনে এ ধারণা হয় যে বামফ্রন্ট সরকারের পরাজয় সুনিশ্চিত। ভোট দেওয়ার বিষয়ে ভোটারদের মনে এমন ভাবে কাজ করে। এবার ভোটের প্রচারে মমতা বামফ্রন্ট থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন বিভিন্ন সংবাদপত্র আর বৈদ্যুতিক চ্যানেলের বিজ্ঞাপন, হোর্ডিং, ব্যানার, ছাতা ব্যবহার, শিল্পীদের গানের ক্যাসেট বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করে মোবাইলে মোবাইলে এসএমএস করে ভোট চাওয়ার ইত্যাদি বহু বিষয়ে তিনি প্রচার করে কোন ত্রুটি রাখেনি। ভোটারদের একটা বড় অংশ ১৯৭২ সালের খুন, জখম অত্যাচার দেখেনি। তারা বামফ্রন্টের নেতিবাচক দিকটা দেখেছে। তাদের অনেকেই বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।
ভোটের ফল: – ১৩ই মে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ভোট গণনা হয়। তাতে স্পষ্ট হয় যে তৃণমূল কংগ্রেস একাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান হয়। বামফ্রন্টের বড় বড় নেতারা হেরে যান। কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেস জোট পায় ২২৭টি আসন। তার মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস একাই পায় ১৮৪তি আসন। কংগ্রেস পায় ৪২টি আসন।এস.ইউ.সি. পায় ২টি আসন। বামফ্রন্ট পায় ৬২টি আসন। সি.পি.এম পায় ৪০টি আসন।সি.পি.আই পায় ২টি আসন, আর.এস.পি পায় ৭টি আসন, ফরওয়ার্ড ব্লক পায় ১১টি আসন। সমাজবাদী পার্টি পায় ১টি আসন, বি.জে.পি পায় ৩টি আসন।মোর্চা আর নির্দল পায় ৫টি আসন।
শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান:- দীর্ঘ ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট শাসনের অবসানের পর মমতার নেতৃত্বে কংগ্রেস আর তৃণমূল কংগ্রেস মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয় ২০শে মে ২০১১ সালে। ১তা বেজে ২ মিনিট থেকে। শপথবাক্য পাঠ করান রাজ্যপাল কে.আর. নারায়ন, ভোটসাথী কংগ্রেসকে পূর্ণ মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীসহ ৭টি দপ্তর ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মোট ৩৫ জনবিধায়ক কে নিয়ে তারা মন্ত্রিসভা গঠন করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।ওই ৩৫ জনের মধ্যে ৩১ জন পুর্ন্মন্ত্রী আর ৪ জন প্রতিমন্ত্রী। শেষপর্যন্ত মমতা রাজ্যর মন্ত্রীসভার ৪৩ জন মন্ত্রীর স্থান হল। কোর্টের নির্দেশে মত এ রাজ্য মন্ত্রিসভায় সর্বোচ্চ ৪৪ জন মন্ত্রী থাকতে পারে।সে দিক দিয়ে ১ জন মন্ত্রী কম হলেও ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন যে তাঁর মন্ত্রিসভার আকার ছোট হবে, কিন্তু তা হল না।
উপসংহার:- পশ্চিমবঙ্গের জনগণ অনেক আশা-আকাঙ্খা নিয়ে নতুন সরকারকে এনেছে। তবে বিরোধী আসনে বসে আন্দোলন করে সরকারের বিরোধিতা করে মানুষের মন জয় করা আর প্রশাসকের আসনে বসে জনগণের কল্যাণ ও উপকার করে তাদের মন জয় করার মধ্যে পার্থক্য আছে। তা এক জিনিস না। তখন থাকে তাদের দায়িত্ব তাকে বাধ্যবাধকতা আবার বাঁধাও থাকে। বিরোধী আসনে বসে যৌথবাহিনী তুলে নিয়ে যাওয়ার দাবি তোলা যায় কিন্তু প্রশাসকের আসনে বসে বসে তা সম্ভব নয়। বিরোধী আসনে বসে শিল্পপতিদের শিল্প গুটিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করা যায় সরকারের আসনে বসে থাকা সম্ভব নয়। পাহাড় চুক্তিতে গোর্খাল্যান্ড শব্দটি কতটা যুক্তিযুক্ত তা পরে বোঝা যাবে চুক্তির বিষয়ে সর্বদলীয় বৈঠক হলে প্রশ্ন উঠত না। এতদিন বিরোধী ভাবধারা বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেখা গেছে এবার তাকে দেখা যাবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আর প্রশাসক হিসেবে।