কে সেই রাজপুত্র যিনি রাজৈশ্বর্জ, ভোগবিলাস প্রাচুর্যের উন্মাদে প্রবাহে জীবন না ভাসিয়ে জীবন রহস্য সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন। যিনি মানুষের হাতে তুলে দিলেন মরণজয়ী মহামন্ত্র, যিনি মানুষকে দিলেন মহানির্বাণ পথের সন্ধান।
যিনি যৌবনের সর্বত্যাগী যোগী, যার জীবন সাধনা মৈত্র করুণায় মৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র উজ্জীবিত করল বিশ্ববাসীকে, অমৃতবাণী হলো জাতির আলোক উৎস, যিনি প্রচলিত বৈদিক ধর্মের জটিলতা, অনুষ্ঠান ও প্রচার প্রিয় তার প্রতিবাদে তিনি হলেন করুণাঘন ভগবান বুদ্ধ, তিনি কপিলাবস্তু রাজপুত্র শুদ্ধদন তনয় সিধার্থ।
জন্ম ও বংশ পরিচয়
প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে কপিলাবস্তু রাজ্যর রাজা ছিলেন শাক্যবংশীয় শুদ্বদন। এল বৈশাখী পূর্নিমা তিথি, শালবৃক্ষ আবেশে এক দিব্য সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেন নাম তাঁর সিদ্ধার্থ এবং যাঁর মাতা হলেন মায়াদেবী।
কিন্তু সন্তানের জন্ম মুহুর্তেই মায়াদেবীর মৃত্যু হয়। বিমাতা গৌতমী সিদ্ধার্থকে লালন-পালন করলেন। সেই সুত্রে ‘গৌতম’ তাঁর ওপর নাম।
শৈশব ও যৌবন
যে বালক উত্তরকালের মহানায়ক, যিনি মানুষের মুক্তিদাতা, তাঁর অনেক উদ্বাসিত প্রদর্শিত পথে মানুষ পেল প্রকৃত পথের সন্ধান। তিনি শৈশবে অনন্য, শান্ত স্বভাব, উদাসী, নির্লিপ্ত। সিদ্ধার্থ বৈভববিলাসে আকর্ষণ বোধ করেন না। অপরের দুঃখ, কাতরতায় তাঁর অন্তর করুনায় প্লাবিত হয়।সর্বজীবে তাঁর গভীর প্রেম । অহিংসার শুচিতায় তিনি শুভ্রপ্রাণ।
কান পাতলেই তিনি জীবের মহাক্রন্দন ধ্বনি শুনতে পান।মনে মনে তিনি অনন্ত সত্যকে খুঁজে বেড়ান।পিতা শুদ্ধধন পুত্রের চিন্তায় বিচলিত হন।সাংসারিক ভোগের জগতে তাঁকে প্রলুব্ধ করার জন্য এক পরমা রূপসী সর্বগুনান্বিত কন্যার সঙ্গে বিবাহ দিলেন, সে কন্যারত্নের নাম গোপা, কিন্তু নারীররূপও তাঁকে সংসারসক্ত করতে পারে না। ব্যর্থ হয় ভোগবিলাস, নৃত্য-গীতের প্রলোভন – আয়োজন।
তপস্যা ও দিব্য জ্ঞান
সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করে তিনি তীর্থে তীর্থে পর্যটন করলেন। করলেন বহু সাধুসঙ্গ।চলল কঠোর তপস্যা। অনাহারে অনিদ্রায় তিনি দুর্বল হলে। মগ্ন হলেন উরুবিল্ব নামক স্থানে কঠোর তপস্যায়। তবুতো দিব্য জ্ঞান লাভ হল না। তিনি উপলব্ধি করলেন মানসিক একাগ্রতা জন্য দেহ ও মনের সুস্থতা প্রয়োজন। তিনি নৈরঞ্জনা নদীতে অবগাহন করলেন।
বোধগোয়া এক অশ্বস্ত বৃক্ষতলে বসলেন ধ্যানে। একদিন এক ধনবান বনিক কন্যা সুজাতা গৌতমকে দেবতা জ্ঞানে মিষ্ঠান্ন বিতরণ করলেন। গৌতম অনাহারে ক্লিষ্ট। দুর্বল দেহে নতুন করে শক্তি লাভ করলেন। গৌতম হলেন ‘বুদ্ধ’ অর্থাৎ জ্ঞানী, হলেন ‘তথাগত’ অর্থাৎ পরম সত্য- সন্ধানী। সেই অস্বস্থ ব্রিজ্ঞ হল ‘বোধিবৃক্ষ’ সেই স্থান হল বুদ্ধগয়া।
ধর্মপ্রচার ও দেহত্যাগ
বুদ্ধত্ব লাভের পর তিনি ধর্ম প্রচারে মন দিলেন। সারনাথের উপকন্ঠে মৃগশিখাবন। সেখানে তিনি সর্বপ্রথম তাঁর ধর্মমত প্রচার করলেন। এরপর দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি বিহার ও অযোধ্যার বিভিন্ন জায়গায় বৌধধর্ম প্রচার করেন। প্রতিষ্ঠা করলেন বৌদ্ধ সংঘ।
ধনী-দরিদ্র, উচ্চ-নিচ নির্বিশেষে সকলেই তিনি সমান চোখে দেখতেন। ধর্মের জটিলতা থেকে তিনি মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। ৮০ বছর বয়সে কুশী নগরে হল তাঁর মহাপরিনির্বাণ।
বুদ্ধের জন্মের পর আড়াই হাজার বছর পার হয়ে গেছে। আজও পৃথিবী হিংসায় উন্মত্ত, স্বার্থে স্বার্থে দ্বন্দ্ব-মগ্ন আজও বর্ণ-বৈষ্যমের উগ্রতা, জাতিভেদ প্রথার রক্তলিপ্ত কলঙ্ক, ভোগ বিলাসের দুর্নিবার মহাকর্ষণ, মনুষত্ব্য লাঞ্চিত, মানব লুন্ঠিত। বুদ্ধদেব মানুষকে শাস্বত সত্যর পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।তিনি মানুষের হৃদয়ে অনন্ত প্রেম জাগরণ ঘটাতে চেয়েছিলেন।
তাঁর দুঃখ নিবৃত্তির পথ তো দুঃখ কে স্বীকার করে দুঃখে জয়েরই অভয়ামগ্ন, তাঁর প্রচারিত মুক্তি তো কর্মত্যাগ নয়, সাধুকর্মের মধ্যে আত্মত্যাগ, যে দেবতা মানুষকে কেবলি হিংসা, স্বার্থের রক্ত রঞ্জিত পথে টেনে নিয়ে যায়, সে দেবতা তিনি স্বীকার করেননি। তিনি ছিলেন সাম্যসাধক প্রেমের পুজারী ছিলেন তিমির হারি, আলোকময় পুরুষ।